সোমবার, ২৩ নভেম্বর, ২০০৯

কারমেন এবং রাজহাঁস

এ হচেছ কারমেন এবং রাজহাঁস
রাত গাঢ় হলে হণ্টন এদের স্বভাব
চাঁদের শরীর থেকে অতৃপ্ত আলোগুলো
যখন পুরনো দেয়ালগুলোকে ছাড়তে আর ধরতে থাকে, তখন
নিয়নের অপরূপ ধোঁয়ার ভেতর হাঁটতে থাকে ওরা
কারমেন এবং রাজহাঁস...

অন্ধকারের সুতোয় গাঁথা আছে
এখানে-ওখানে শুয়ে থাকা গলিগুলো
বিশাল কোন এক খাতা থেকে তারপর
নাম ডেকে চলে কেউ, যেহেতু নির্বাচন আসছে;

একটা রসিমন রাস্তার পাশে কি অবলীলায়..
পাল্টে নিল তার শাড়ি,
এইখানে এসে তাই
রিকশাগুলোর গতি কমে যায়...

আব্বাস নামের কেউ একজন ভিক্ষুক
কালাম নামের কেউ একজন হেলপার
আয়েশা নামের কেউ একজন ফুলওয়ালী
অদ্ভুত কুঁকড়ে থেমে যায়
কেননা ও-প্রান্তে প্রবেশ নিষেধ
সরকারী বন্দুক হাতে কিছু নির্বোধ লোক
টহল দেয়, তাদের ভেতর কুচকুচে বীভৎস
কিছু ছায়া, ছোট আগুন জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে
ক্রসফায়ারের আনন্দে উত্তপ্ত...

কেউ বুঝতে চায়নি কখনও
এ শহর কেন কোনদিন কারো নয়
কারণ সবাই কারমেন নয়
সবার রাজহাঁস হয় না
আর কারও পাঁজর অন্ধকারে
জোছনা বিলোতে পারে না..

এরপর রাত বাড়ে..
ধীরে ধীরে -
নর্দমার স্রোতের সঙ্গীত স্পষ্ট হয়..
পরিত্যক্ত একটা গাড়ীর ভেতর একটা কালাম
একটা রসিমনের শরীর থেকে ভালবাসা খুলে নেয়,
বেড়ালের বাচ্চাটা কাঁপতে কাঁপতে মরে যায়..
আর একটা আয়েশা মায়ের মৃত্যুতে ডুকরে ওঠে..
অবশেষে কারমেন এবং রাজহাঁস
অন্ধকার সুতোয় গাঁথা গলিগুলোর চুল
আঁচড়াতে থাকে... ভোর হবার আগ পর্যন্ত...

শেষ রাতের যাত্রা

গলির মোড়ে পৌঁছামাত্র

রাত পৌনে চার

আঁধারের স্বচ্ছ কলজেটাকে খুবলে তুলে

লেপ্টে দেয়া হয়েছে আকাশের শরীরে

মৃত্যুর মতন নিস্তব্ধতা প্রতিটি ল্যাম্পপোস্টে...


নির্জন পথ, সঙ্গ দিচ্ছে

বিদ্যুতের তারে লেগে থাকা প্রতিটি মৃত বাদুড়

ভাঙ্গাচোরা বাসটার গা ঘেঁষে যাই

তার বুকের কষ্ট আর

একটি বেড়ালের শরীর

মিশে আছে নর্দমার ভেতর

কলার খোসা এবং সবজি বিক্রেতার দুঃখের মাঝে


কিছু দূরে

একটা বিলবোর্ডকে ঘিরে কিছু কুকুর পড়ে আছে

কর্পোরেশনের আবর্জনাবাহী গাড়িটা

মাঠের ধারে বিকল,

আবর্জনার স্তুপ তাই ডাস্টবিন ফুঁড়ে

সমস্ত শহরে গন্ধ বিলোচ্ছে..

পথের পাশে তিনটি ভাসমান পরিবার

এবং একটি ঘুমন্ত শিশু

তারপর কেবল অন্ধকার...


হঠাৎ

সেই অন্ধকারের ভেতর ভেসে ওঠে মৃত বন্ধুর মুখ...

পলক ফেলি,

"তুই তো বেঁচেই গেছিস, বন্ধু

আমার যে বড় কষ্ট..

চেয়ে দ্যাখ..

আরো একটি শিশু ঘুমিয়ে পড়েছে,

তার চোখের জল শুকিয়ে যাচ্ছে,

তার বুকের হাড়গুলো তাকিয়ে আছে আমার দিকে,

ওর পাকস্থলিতে ক্ষুধা ওঁৎ পেতে আছে

ঘুম পালালেই জাপটে ধরবে ওকে,

শিশুটি কাকে জাপটে ধরবে বল..."


আবার চলতে হয়

কুয়াশার মধ্যে নিজেকে একলা লাগে...

বন্ধুর মুখটা ধীরে ধীরে মিশে যায়

দেয়ালে লেপ্টে থাকা একটি লাল অক্ষরের ভেতর ।।

শুক্রবার, ১৩ নভেম্বর, ২০০৯

যুবক-যুবতী

।১।

যুবতীকে কেউ দ্যাখেনি,
যুবক সারাটা দুপুর রাস্তার ধারে,
তার বুকপকেটে আগলানো চিঠিখানা
উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠার ঘামে ভিজে উঠেছে,
সস্তা কলমের কালি, জড়ানো হাতের লেখা
যুবকের বুকের কম্পন ;

অজস্র ভুল বানানের মাঝে -
ভালবাসি শব্দটাই অনায়াসে
পড়তে পারে যুবতী,
ঠোঁটখানা হালকা বাঁকায় সে,
বুকের ভেতরটায় কী যে হচ্ছে
স্বয়ং ঈশ্বরও জানেন না,
আলগোছে হাতব্যাগের ভেতর,
নানান জিনিসপত্রের সাথে
মিশে যায় চিঠিখানা ।।


।২।

রেস্তোরাঁ উপচে পড়া ভীড়,
মুখোমুখি যুবক-যুবতী...
যুবতী বলল -
পরশু আমার বিয়ে
লক্ষীটি হয়ে আসবে,
হালকা সবুজ রং-এর মাঝে
হালকা প্রিন্টের একটা শাড়ি
আমার চাই-ই চাই,
নাকী তা-ও পারবেনা...

যুবক মাথা নীচু করে
ছুরি দিয়ে কাটলেট কাটে,
কেবল কাটে, আবার কাটে,
কাটতেই থাকে...
যুবতী আবার বলে -
একী খাচ্ছ না কেন ..
যুবক একবার মাত্র তাকায়
হাসার চেষ্টা করতে করতে বলে-
কাটলেটটায় ঝাল বড় বেশি
খাওয়া যাচ্ছে না..

যুবতী পানির গ্লাস এগিয়ে দেয় ।।

কুয়াশার ভেতর

কুয়াশার ভেতর
অবশিষ্ট উষ্ণ নিঃশ্বাসে
লিখবার ইচ্ছে ছিল
নিতান্ত ছোট একটি বাক্য
নিদেনপক্ষে একটা শব্দ

বুকের পাঁজর ফুঁড়ে
উঠে এল দীর্ঘশ্বাস
পুরনো, শীতল

অসুখ, অসুখ

অনেক অনেক রোদ
ছাই হয় ঝোপ, ফণিমনসার
হঠাৎ হাওয়ায়, শরীর ভিজতে চায়
মেঘ নয়, তার কাছে বৃষ্টি নেই
উড়ে যায় হাওয়াদের প্রেত
মৃত শকুনের পালক
অসুখ, অসুখ

বৃহস্পতিবার, ৫ নভেম্বর, ২০০৯

একটা স্বপ্ন ছিল

একটা স্বপ্ন ছিল
খুব কাছ থেকে কেউ ডাকবে রূদ্র
আর আমি ডাকবো নদী

বুকের খুব ভেতরকার স্বপ্নটুকু বুকের আরও ভেতরে
অভ্যস্ত দীর্ঘশ্বাসে পাশ পিরে শোয়
কেউ কখনো রূদ্র নামে ডাকেনা
আমিও নদী নামে ডাকার মতন কাউকে খুঁজে পাই না..
দিনের পর দিন, হেঁটে হেঁটে কোথায় যেন চলে যায়;
আজ পকেট হাতড়ালে, খুচরো আর ছেঁড়া কয়েকটি নোট
স্বপ্নদের কোন পকেটে যে রেখেছি..
লোকাল বাস, মানুষের স্তুপ,
এরকাঁধ, ওর মাথা, তার চোখ - কপাল
আধুনিকার ঠোঁট, ঝগরুটের বুক
আমিতো এভাব দাঁড়াতে চাইনি..
ভাবতে ভাবতে স্টপেজ এসে যায়,
কেউ একজন উঠে গেলে বসে পড়ি,
বসে বসে ভাঙ্গাচোরা স্বপ্নদের জোড়া দিই,
আবার ভেঙ্গে যায় ওরা,
হাতে নিই, স্বপ্নদের চুলে বিলি কাটি.. আদর করি..
হঠাৎ সহযাত্রীর ধাক্কায় পড়ে যায় ওরা.. হারিয়ে যায়..
মানুষের ভীড়ে তাদের আর খুঁজে পাইনা ..

সেই তো একটা স্বপ্ন ছিল.. হারিয়ে গেলো..
বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে কেউ একজন ডাকবে রূদ্র,
আর আমি - নদী ।

কালকেউটে সুখ অথবা দুঃখ

বুকটা যে কারণে অগ্রাণের হাওয়ার মতন কাঁদছিল
একই কারণে আজ তুমি-আমি-আমরা সবাই
পৃথক-বিচ্ছিন্ন-বিযোজিত
দুপুরের বয়স বাড়তে বাড়তে হাওয়া ওড়না পাল্টায়
বিগলিত অগ্রাণ রোদ অস্থির
এর অন্তঃস্থিত পুরনো বাষ্পীভূত কষ্টগুলো
নতুন রূমালে দাগ কাটে
কে না জানে
ঘাম আর কান্নার দাগ মেশে না কোনদিন।
হঠাৎ সশব্দে জাগে বুকরে ভেতরটা
নতুন প্রেমের গন্ধে আজও মেতে উঠতে চায়
অবশিষ্ট অনস্থমজ্জার কাঠামো
এখন নিশুতি গন্ধ বাতাসেতে
অমাবস্যা এলেও জানি চরকা কাটেনা চাঁদবুড়ি
নকল সুখের উত্তাপে ভিজে ওঠে দেহের অন্দরমহল
কালকেউটে সুখ অথবা দুঃখ...

যা কিছু সহজ

গাছের পাতারা ভীষণ সহজ, সবুজ
এলোমেলো বাতাসেরা দৌড়োয়,
সহজ তাদের হামাগুড়ি, লুটোপুটি
রোদেরা স্বচ্ছ, সরলরেখায় স্পষ্ট ছায়া কেটে উপুড় হয়ে
শীতল ঘাসে, নিবিড় ধুলোমাটিতে, সহজ ঘুম
পাখিরা দ্রুত ওড়ে, পেট পুরে খায়, ঘুমযায়, সন্ধ্যায়, ছোট্ট বাসায়
পিঁপড়েরা কাজ করে, সকালে - বিকালে, ঘুমায় না, গানও গায় না
ধারালো সাঁড়শিতে কেটে খাবার জমায়, শীতের সহজ সঞ্চয়
চড়াই, টিকটিকি, কুনোব্যাঙ.. সহজ খেলায় মাতে
বালুতে, সিলিঙে, ইটের ফাঁকে.. এই সহজ আবাসে
আর যা কিছু সহজ, তা সহজেই মিশে যায় সহজ বাতাসে,
জলে, মাটিতে, আকাশে আর সহজ পৃথিবীতে ।।

রাত

গাঢ় পাতার ফাঁকে টুপটাপ অন্ধকার
আকাশের চোখ আধবোঁজা লাল;
মেঘের কাজল উপচে উদাসীন,
আকাশমণির পাতাদের দল -
সাঁঝের আকাশে ছায়া কাটে,
শিমুলের ছায়ায় ছায়া হয়ে আছে বসে থাকবার পুকুড়পাড়,
বড় সাধের ছোট্ট জানলায় নিরিবিলি সন্ধ্যার শরীরের গন্ধ;
তারপর -
তারারা যখন মেঘ চেপে উল্লাস করে,
খোলা চাঁদের খেয়ায় ঘুমন্ত শালিককে যখন
আর দেখেও দেখে না কেউ, তখন -
আসে রাত,
চাঁদ, তারা অথবা অন্ধকারময় ।।

ভীষণ এক ঝড়ের প্রস্তুতি

হঠাৎ টের পেলাম,
এই মুহুর্তে ভীষণ এক ঝড় উঠবে
আমি বাতাসকে চিনি, সে আজ ভীষণ অস্থির
একটু একটু করে অন্ধকার নামে নগরীর পথে
বুড়ো বটগাছটার পাতার স্তুপে মাতম উঠেছে
আমি দেখতে পাচ্ছি,
ধুলোর ভেতর ছায়া জেগে উঠছে
ধীরে ধীরে সব জানলা বন্ধ হয়ে যায়
সকল দরোজায় কপাট পড়ে সশব্দে,
মেঘেদের মৌন মিছিল অধিকার করে নিচ্ছে
মানুষের আকাঙ্ক্ষিত আকাশ
নাগরিক পাখিদের তাড়াহুড়োতে কোথায় যেন সাইরেন বাজে
সশব্দে চলে যায় বার্তাবাহক গাড়ী
দিনমজুরের দল যাত্রীছাউনির নীচে জবুথবু
ছোট এক টোকাই প্লাস্টিকের থলে হাতে কোথায় যেন চলে যায়
ভিক্ষুকর থালায় উড়ে আসে মেহগনির ফল
কোন এক অন্ধগলির বাসিন্দা ডুকরে কেঁদে ওঠে
বদ্ধ জানলার ওপাশে -
মোমবাতির আলোয় দৃশ্যমান হয় সদ্যেজাতের মুখ;
আর আমি -
কেবল ঝড়ের গন্ধ শুকেঁ দেখি, ঝড় আসছে ।।

বুধবার, ৪ নভেম্বর, ২০০৯

আমি আর এক কাপ ঠান্ডা চা

টেবিলের উপরটা ধুলোর রাজত্ব
তার এক কোণায় সাদা এক কাপ
সূক্ষ্ম ধোঁয়ার আনাগোনা নেই, নিষ্প্রভ চা
এই এক কাপ ঠান্ডা চা আর আমি
এই নিয়ে সংসার
বাকীটা ধুলোর অন্ধকার,
জানলা দিয়ে আলো আসে, ধুলো আসে
আমি এক কাপ চায়ের আশ্রয়ে
বাতাসে মিলিয়ে যাই

বাইরের পৃথিবীটা গাঢ় মেঘের আওতায়
ওটা আমার নয় আর
সবুজ মাঠ, চৈত্র্যের রোদ, দক্ষিণের বাতাস
আর যা কিছু -অন্য কারো
আমার শুধু
এক কাপ ঠান্ডা চা
যা কেবলই আমার ।।

অদ্ভুত শৈশব

সারবাঁধা অনেকগুলো কৃষ্ণচূড়ার গাছ,
ডিসেম্বরে তখন বার্ষিক পরীক্ষার সময়
একশোটা রোদ্দুর যেন গাছগুলোর ডালপালা চিরে
আছড়ে লুটোপুটি খেত, কবেকার চুন সুরকিতে..
আমার প্রথম ইস্কুল..
সকাল সকাল পরীক্ষার দিন
ঠান্ডায় হাত যেন চলতে চাইত না
কী ভীষণ ভয়ংকর অংক পরীক্ষা
নতুন নতুন পেন্সিল আর রবারের গন্ধে কেমন ভরে থাকত বিশাল ঘরটা
মস্ত বড় পরীক্ষার ঘর.. পরীক্ষা পরীক্ষা গন্ধ..
পরীক্ষা শেষ হলে মজার এক বন্ধ আসত,
তখনও কৃষ্ণচূড়ার লাল লাল মুখ নিয়ে বসে থাকত আমার ইস্কুলটা
আমার প্রথম মাঠ,
ছোটবেলাকার কারো সাথে কৃষ্ণচূড়ার রেণু নিয়ে খেলা.. বন্ধুহীন শৈশবের বেলা
নিজেকে নিয়ে তখন অঢেল সময়..

সাড়ম্বরে আসত ছাব্বিশ মার্চ..
সবাই লেফট-রাইট করত, আমি কেবল হুমড়ি খেতাম
আরো বড় এক মাঠ ছিল, সবাই স্টেডিয়াম ডাকত,
সবাই কত কী করত..
আমি কেবল বোকার মত দেখতাম..

যে বাসাটায় আমরা ভাড়া থাকতাম তার সামনের পথে
শিমুলের তুলো উড়ে উড়ে আসত..
বন্ধ ঘরে বুকের ভেতরে একটা মন পালাই পালাই করত,
সেই পুরনো বাড়িটার কোণায়, শ্যাওলায় শ্যাওলায়..
আমার অদ্ভুত শৈশবটুকু ফেলে আসতে হয়েছে ।।

আরো একটি ঝড়ের কবিতা

বহুদিন পর কোন ঝড়ের কবিতা লিখছি,
কাল বিকেলে শরীরটাকে ডুবিয়েছিলাম ঝড়ের সমুদ্রে,
চার হাত-পা, বুক-পিঠ সব ছিল ভূমির সমান্তরালে..
ঘামে সপসপে হয়ে যাওয়া আদিম বুকটা
কঙ্ক্রিটের বেঞ্চিতে নকশা কেটে লেপ্টে,
বাতাসের ঘূর্ণিতে জগতের ধুলো
আমার মাথার চুলে জট পাকিয়ে যায়..
আর পিঠের উপর জড় বজ্রাসনে ধ্যানে,
তারপর..

যাবার আগে কিছু একটা বলেছিল সে..
বিদ্যুতের চমকের মত হয়তো তা ঝলসেও উঠেছিল,
অথচ আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন.. বাতাসের হাহাকারে
বজ্রের হুংকারে তন্দ্রা ভাঙলো ঠিকই
তবে ঝড়কে পেলাম না খুঁজে আর..
ঝর ঝর বৃষ্টি নামল ছাদের সাদা বুকে..

তখনও বৃষ্টি থামেনি,
ভাবছিলাম ভিজি..
সে কী মুষলধারের ধার..
ভয় হল.. ভাসিয়ে নেয় যদি..
আমি তো সাঁতার জানি না....

এক অদ্ভুত সকাল

কিছু কিছু সকাল আসে
গায়ে জড়িয়ে হলুদ নরোম রোদ
যা কিনা নরোম হাঁসছানার চাইতেও
গতরাতে - আমায় না করে দিয়েছ তুমি
অথচ দেখো সকালটা কত অদ্ভুত
আমগাছটার গায়ে কেমন লেপ্টে আছে রোদগুলো ।।

উল্টো আকাশ

কাল
একলা সকাল
ভীষণ ফর্সা মেঘ
স্বচ্ছ হলুদ রোদ
মিষ্টি কোন গান
খুব আপন বাতাস
অচেনা গাঢ় নীল ফুল
পুরনো ভালবাসা
টুকটুকে সূর্য
অবশেষে উল্টো আকাশ

কতটা একলা হলে কেউ

কতটা একলা হলে কেউ
কেবল নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ শোনে
তার সাথে মিশে থাকে বাতাসের কিছু কথা
মাঝরাতের বিষণ্ন এক টুকরো অন্ধকার
স্যাঁতস্যাতে ঘুমোবার ঘরে পুরনো এক ফ্যানের কান্না
- আর কেবল নিঃসঙ্গতা
শেষ রাতে এক ছলক আলোয় ভেঙ্গে যাওয়া রাতের গভীরতা

কতটা একলা হলে কেউ
দিনের আলোর থেকে পথ খোঁজে পালাবার
আর জীবন থেকে
হারিয়ে যাওয়া প্রেম থেকে
বুকের একটি জায়গায় কেউ থাকেনা, সেখানে

শরীরের কোথাও এক টুকরো পুরুষমানুষ থাকে
কতটা একলা হলে কেউ
কেবল নিজেকে আদর করে ফেরে
কারো চোখে চোখ রাখতে ভয় পায়
ভুলে যায় ।।

গাঢ় এক দুঃখ

অনেক দীর্ঘশ্বাসের শেষে গাঢ় এক দুঃখ এসেছে
সন্ধ্যে নামার সাথে সাথে এই দুঃখটা জাপটে থাকে সারাটা শরীর,
দুচোখের মাঝামাঝি কোথাও কান্নারা বসে আছে অপেক্ষায়,

এভাবেই সন্ধ্যারা সকালের পাশে
তিল তিল গড়ে তোলে গাঢ় অন্ধকার
শব্দের গা বেয়ে নৈঃশব্দের কষ
তার ঠিক বাঁ পাশে
একটা অতৃপ্ত মাংসের টুকরো
রোদের মৃতদেহ নিয়ে
বল্গাহীন দুঃস্বপ্ন বুকে...

পার্শ্বচরিত্র

অদ্ভুত এক নাটক হচ্ছে জীবন
বড়ো বড়ো নায়ক আর নায়িকাদের ভীড়ে
কোনরকম পার্শ্বচরিত্র আমি এক
ঝড়-জল-রোদ বাচিয়ে বেঁচে থাকি,
সকাল সকাল কিছু একটা অজুহাতে ঘুম শেষ হয়
তারপর নানা একঘেয়ে কাহিনীতে দিন বুড়ো হয়
রাতে ঘুম লাগার আগ পর্যন্ত
মন খারাপ করা অন্ধকারে গা-ডুবিয়ে বসে থাকি ...

কিছু কিছু সুখস্মৃতি আছে
তাই মাঝে মাঝে উল্টে-পাল্টে দেখি,
স্যাঁতাপড়া আনমনা ছন্নছাড়া কষ্টে
ভিজে থাকে ভেতরে কোথাও
একা অপেক্ষায় থাকি, কোন এক বাতাসের
দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে, চাপা দিই..

মাঝে মাঝে হাঁটার সময় আকাশ দেখি
ভাগ্যিস কারো চোখে পড়ি না
গলির কুকুরগুলোর সাথে দৌড়াই
যদিও মাঝে মাঝে কষ্ট লাগে,
পরে সব ঠিক হয়ে যায়, কম কথা তো নয়..
ঝড়-জল-রোদ বাচিয়ে বাঁচা হাজারো পাশ্বচরিত্রের অন্যতম ।।

থেমে আছে রোদ্দুর

বারান্দায়
থেমে আছে রোদ্দুর
তোমার ঠিকানা আর কদ্দুর

পিছলে যাচ্ছে সময়
বুকের মাঝে
ঢুকে যাচ্ছে ভয়

একা বসে আছ কোথাও
মুঠো ফোনে একটু জানাও
ভালবাসি তোমায় ভেবেই
ঘর খুজিঁ তোমার চোখেই

ভালবাসার রঙটা রোদে
মিশে আছে উল্টো চাঁদে
ভালবাসার রঙটা রোদে
মিশে আছে উল্টো চাঁদে


বারান্দায়
আজো আছে রোদ্দুর
জীবন মোহনা আর কদ্দুর

বদলে গেছে বিকেল
বেড়ে গেছে আজ যুদ্ধ-জেল

একা তুমি নেইতো আর কোথাও
তবু তুমি এখনও ভাবাও
ভালবাসা বলতে কিছু নেই
বেঁচে থাকা যেমন ছিল সেই

মাঝখানে পুড়ে গেলো মন
ঘুমহীন রাত্রি যায় এখন
মাঝখানে পুড়ে গেলো মন
ঘুমহীন রাত্রি যায় এখন

ঘুমে হারিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত

আমার রাতে ঘুমোবার আগে কষ্ট হয়
শুয়ে শুয়ে কষ্ট হয়
বুকের কোথাও ফোঁটায় ফোঁটায় কষ্ট জমে
রাত্রি যত গাঢ় হয়
কষ্ট বাড়ে
ঘুমে অচেতন হবার আগ পর্যন্ত

উল্টোপাল্টা স্বপ্ন হয় ঘুমের ভেতর

কোন না কোন ভাবে দিন যায়
তারপর ঘড়ির কাটায় টিক টিক রাত বাড়ে
রাতে ঘুমানোর আগে আবার কষ্ট হয়
উপুড় হতে কষ্ট হয়
ধীরে ধীরে বুকে জমে কষ্ট
এরপর রাত যত গাঢ় হয় ....
.......
....ঘুমে হারিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ....

দুঃখটুকরো

।১।

কেউ জানেনা দুঃখগুলো কবে
উঠোন ছেড়ে দৌড়িয়ে পালাবে

।২।

দুঃখগুলোর বসত কোথায়
দুঃখ ছেড়ে কেউ কি পালায়
এ ভবে যে সুখের কাঙাল
সে-ও পালায় দুখের কাছেই সুখকে ছেড়ে

।৩।
দুঃখটাকে আগলে রেখে বুকে
অশ্রুফোঁটা হাসির আলোয় ঢেকে
উঠেই দেখো খিলখিলিয়ে
দুঃখ আপন সবচে' আপন
দুখই জীবন

।৪।

দুঃখ নাকি আমার মানিকজোড়া
কেউ বলেনি বলছে মন-ই
মনটা বোধহয় ঘর ফিরেছে
অনেক অনেক রাতের পরে

।৫।

বহুদিন পর
চোখের শরীর বেয়ে
টপ টপ লবণপানি
দুঃখ বুঝি উছলে উছলে পড়ে

।৬।

কষ্ট লাগে..
অশ্রু লাগে..
দুঃখ লাগে..
এক জীবনে..
সবই লাগে..

জীবন-কবিতা

জীবন আর কবিতা নয় এক
তবুও জীবন কবিতায় এলোমেলো
নাকি জীবনই কবিতাকে এলোমেলো করে দেয় ...

কবিতা ছাড়া কেউ কেউ বাঁচে না..
আবার এই কবিতার জন্যই কেউ কেউ পারেনা জীবনকে পুরতে
হাতের মুঠোয়..
পারেনা চলতে.. আর দশটা মানুষের মতন
কবিতাই তাদেরকে আলাদা করে দেয়..
একা করে দেয়...

প্রেম

রিনির শরীরটা জিব দিয়ে ছুঁয়েছিলাম
বয়স তখন আমার সাত
অত ছোট বয়সটাতে চুমো দেয়া হয়নি বোধহয়;
শিমুলদিদি দেখতে ভাল ছিল, প্রেম প্রেম ভাব হত
আজও মনে আছে, দিদির টমেটোর মতন গালটা;
বাসার সামনে দিয়ে বিকেলবলো, একলা মিথিলা.. মিথি
চেহারা মনে নেই.. চশমা পরত চায়না ফ্রেমের
না দেখেই প্রেম হয়েছিল, প্রেম সংক্রান্ত আবহাওয়ায়;
নীচতলায় কারা যেন ভাড়া এসেছিল, মিষ্টি এক মেয়ে ছিল ওদের
কী যে ভাললাগতো, রূপ কি প্রথম বুঝতে শিখলাম
একটা মেয়ে এত সুন্দর হতে পারে,
প্রেম হত কিনা জানিনা, কষ্ট হত খুব
ছোটবেলাকার ছোট্ট বুকে, প্রথম কামনা প্রিয়াংকা
মাঝে আরও কেউ এসেছিল, কেউ কেউ আমার জন্য
টিফিনের খাবারটা রেখে দিত;
বপি নামের মেয়েটা, এ আবার কেমন নাম প্রশ্ন ঘুরত মাথায়
ঝুটিবাঁধা চুল আর সাদা সাদা দাঁত, ভালো লেগেছিল
মোহ ছিল, প্রেমও হয়েছিল নিশ্চয়ই;
তারপর জীবনের সাতটা বছর ধরে রীতাকুন্ড..
মুখ ফুটে বলা ওই প্রথম.. হল না;
এরপর প্রিয়তি ছিল, বেস্ট ফেন্ড, প্রেমিকা হতে চাইল না..
যা হোক.. ধানসিঁড়ি এল, এইবার প্রেম হল, দুপক্ষ থেকেই
যদিও আঠারো মাসের বেশি টিকল না, হারিয়ে গেল সে..
আপাতত একাই আছি, আর..
যাকে দেখছি তাকেই ভাল লাগছে, প্রেমও হচ্ছে....

সোমবার, ২ নভেম্বর, ২০০৯

রাত্রিচারণ

আমার এই রাতটি বড়ো আপন
যে রাতে তুমি আমায় ছেড়ে গিয়েছিলে
অনেক অনেক আগে
এসে দেখো, আমি সেই নারকেল গাছটার নীচে শুয়ে -
বুকের বোতাম দুটো সেই যে খুলে দিয়ে গেলে
আর লাগাতে পারিনি...
আবার এসেছে হেমন্ত,
আমায় সান্ত্বনা দিতে
প্রকান্ড চাঁদ তার যাবতীয় জোছনা নিয়ে -
আছড়ে পড়ছে খোলা বুকে
দেখলেনা, বুকের শিশিরে চাঁদ জ্বলে কত অদ্ভুত...

ভগ্ন প্রেমিকের বুকের আগুন নাকি কেবল জ্বলতে থাকে
জ্বলতেই থাকে

তোমায় একটা নাম দিয়েছিলাম, মনে আছেতো
নাকি ভুলেই গেছো -
কত রাত, কত জোছনা, কত কত শিশির ভেজানো কবিতা..
কিছুই কি মনে নেই...
অন্যের বুকে কতটাই বা উষ্ণতা
আমি সংক্রান্ত যা কিছু ছিল...
সব কি ঘামের সাথে বেরিয়ে গেছে ..
আমি কাঁদিনি কোনদিন,
সময় পেলে কেবল জোছনায় ভিজি,
খোলা বুকে মশারা চুমুক দেয়..
আমি তো বোতাম লাগাতে পারিনা আর..
সেই যে খুলে গেছ..

পরিত্যক্ত মানুষের নাকি আর ঘর হয়না
কোনদিন না ।।

রবিবার, ১ নভেম্বর, ২০০৯

একটা ভোর

আকাশে তাকাই, ভোর হয়
যেন আনমনা শিশু এক ছড়িয়েছে রং, ছোপ ছোপ মেঘ..
কিছু হাঁস পুকুরের জলে, দুলে দুলে যায় আকাশের গায়ে ভাঁজ ফেলে...
শহরের শরীর আশ্চর্য শীতল.. রোদ আসছেনা...

কাল রাতে ঘুম হলোনা, দেখতে চাইলাম মানুষ কী করে ঘুমোয় ..
কী করে বৈদ্যুতিক পাখার গুঞ্জনের সাথে মানুষের নিঃশ্বাসের শব্দ মিশে যায়..
মেলাতে পারিনা..

রোদের প্রথম ঝলকে দেখি এক পাতাকুড়োনি মেয়ে.. তাকিয়ে আছে নিস্পলক..
লালচে দালানের সারি সারি জানলার শার্শিতে রোদের আনাগোনা বাড়ে...
আকাশে মেঘের কারুকাজ শুরু হয়..
এখন এটিকে অনায়াসে কোন একজন ঈশ্বরের কাজ বলে ধরে নেয়া যায়...

কেন জানি বিতৃষ্ণা বোধ জাগে...
অদ্ভুত এক শূন্যতা ভেতরে কোথাও,
রাতজাগানিয়া সুখ নেই মোটেই..
রোদ বাড়তে বাড়তে চলে যাই... শব্দহীন...
হঠাৎ এক ঝাপটা নোনাজল...
ঝাপসা করে দিল চলার পথ ।

ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত হবার গল্প

রাত্রিবেলার মানুষগুলো
পথের মাঝে সুখ খুঁজে পায়
আমি হাঁটি কেবল উদ্দেশ্য-গন্তব্যহীন
যেদিকে পথ পাই যাই
সুখ নয়.. ক্লান্তি কুড়াবো
পথে যদি পাই

পলাশী, ফুলার রোড
বিবেকানন্দের সামনে দিয়ে
ছোট পুকুরটার ধার ঘেঁষে
জগন্নাথের গেইট.. তারপর
শামসুন্নাহার হল, লোকারণ্য টিএসসি..
পাবলিক লাইব্রেরির জানলাগুলো...
মধুর ক্যান্টিন.. একটু দাঁড়াই..
নজরুল সৌধের শীতল পাঁচিল ছুঁই..

এরপর আজিজ মার্কেট দুই হাত তুলে ডাকে..
থামি না... কাঁটাবন এসে যায়...
এক সাদা বিলাতী কুকুর তেড়ে এল,
আমি হেসে ফেললাম..
তারপর সোনালী মাছগুলো সাঁতার কাটলো..
হঠাৎ নীলক্ষেতের মানুষগুলো আমায় টেনে নিল চুম্বকের মতো..
তারপর ঠেলতে ঠেলতে ওভারব্রীজ পার করে..
নিউমার্কেটের দুই নম্বর গেটে উগরে দিল,
দেখি দু'টো মেয়েমানুষ হাসছে,
এদের একজনকে আমি চিনি , "ভাল আছেন?"
চিনেও চিনল না ..যাক
আমি না থেমে তিন নম্বর গেট পেরিয়ে নিঃশ্বাসের উত্তাপ টের পাই..
তারপর চন্দ্রিমা, সুবাস্তু, ইস্টার্ণ মল্লিকা.. অনেকটা পথ..
এবার ঘুরে হাঁটা দিই উল্টো পথে..
চাদনী চকের মুখে আমার ছুঁয়ে দিল এক নগরবালিকা..
অবধারিত ভাবে.. আমি ওকে ভালবেসে ফেলি,

একী - ঘামছি কেন আমি,
সারাটা দিন কিচ্ছু খাইনি, পানিও না
দেখতে চেয়েছি, কতটা ক্লান্ত - ক্ষুধার্ত হলে..
কবিতার ভুত দৌড়ে পালায়..
বুকের মধ্যে ধ্বক করে ওঠে ক্ষিধে..সারা শরীর দুলে ওঠে..
ইডেন কলেজের মেয়েগুলোকে দেখেও দেখি না..
মাথার চিন্তাগুলো কেবল ঐখানটায় এসে জট পাকিয়ে যাচ্ছে,
একটু শুতে হবে.. একটু কিছু খেতে হবে... একটু জল...
ঘোলাটে লাগছে আজিমপুর বাসস্ট্যান্ড.. পলাশীর আবদ্ধ বাজার..
পা চলতে চায়না... খুব কষ্ট হয়... চাবি ঘুরাতে...
তালার মুখ হাঁ করাতে...
দেখি ব্যস্ত বিছানা তড়িঘড়ি করে উঠল..
আমায় কোলে করে শোওয়াল..
পিঠ ঠেকিয়ে আমি অবাক -
নিজের অজান্তে কবিতা চলছে ... প্রলাপ বকছি...
কতটা ক্লান্ত হলে... কবিতা উড়ে যেতে চায়... পারে না...

ভীষণ খিদে.. ইচ্ছে হয় গোটা ডাইনিং হল গিলে খাই...
দেখি সাকিব সেঞ্চুরী করছে...
স্বচ্ছ ঝোলে মুরগী ভাসছে...

স্বর্ণা বলেছিল ..

স্বর্ণা বলেছিল .. এসোনা আর কোনদিন
আরও বলেছিল .. ভাল হয়ে থেকো
আমি কথা রাখতে পারিনি...
হাতে পয়সা জমলে আজও স্বর্ণাকে খুঁজি..
স্বর্ণা ছিল না আর কোথাও...
স্বর্ণা নেই...

স্বর্ণা.. আমি খুব নীরবে বাঁচব
দেয়ালের সাথে মিশে থাকব..
একদম টের পাবে না...
তবু তুমি আসবে না ?

ঘাসবন্ধু

আমার ঘাসবন্ধুটা বলল, আজ পূর্ণিমা
চায়ের সাথে জোছনা গলিয়ে খাই চল..
আমি কিছু বলতে পারিনি,
অদ্ভুত গোল চাঁদ জোছনা বিলোয় আর হাসে
চায়ের সাথে সে জোছনা গললনা কিছুতেই...
মেঘ থমথম করছে বুকের আকাশে
ভয় হয়.. রাত গাঢ় হলে ঝড় না ওঠে...

আমার ঘাসবন্ধু রাত জেগে অংক করবে..
আমি অবাক হয়ে ওর চোখ দুটো দেখার চেষ্টা করব...
যে বন্ধু.. আনমনে মিশে গেছে বাহুর ভাঁজে ।

প্রেম

একটা ছেলে বুক খুলে পড়ে আছে
একটা মেয়ে ঝুঁকে ঝুঁকে ভালবাসা নিচ্ছে
সিলিং অন্ধ..
মাঝে মাঝে দেয়ালগুলো আড়চোখে তাকায়..
আর মেঝে .. কেঁদে কেটে হতবাক...